বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

নাজমুন নাহার 

প্রকাশিত: ১৫:৩০, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

একুশে ফেব্রুয়ারি: ভাষা, ত্যাগ ও বিজয়ের একটি কালজয়ী প্রতীক

একুশে ফেব্রুয়ারি: ভাষা, ত্যাগ ও বিজয়ের একটি কালজয়ী প্রতীক
নাজমুন নাহার

"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?" একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলার মত নয়, কিছুতেই ভুলা যায় না-- বাংলাদেশের ইতিহাসে এ এক অনন্য গৌরব-গাঁথা। আমরা বাঙালিরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি, এই জীবনের বদলে পেয়েছি বাংলায় "মা" বলে ডাকার অধিকার। 

২১ শে ফেব্রুয়ারি সকল বাংলাভাষী মানুষদের জন্য এক গৌরবময় দিন। ৫ই আগস্ট ২০১০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক এক সিদ্ধান্ত মোতাবেক একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যার পর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে। 

১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হল ব্রিটিশ ভারত-- তৈরি হল ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তান আবার দুটি খন্ডে বিভক্ত-- পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান। এই দুই ভূ-খন্ডের ভেতর ভৌগলিক দূরত্ব ছিল ১৮০০ কিঃমিঃ; আর ভাষা- কৃষ্টি- সংস্কৃতির ব্যবধান ছিল যোজন যোজন। বহু জাতিসত্ত্বা নিয়ে গড়া তৎকালীন পাকিস্তানের মাত্র ৬ শতাংশের ভাষা ছিল উর্দু, যেখানে ৫৪ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। বাঙালির আত্ম-অম্বেষায় ভাষাচেতনার যে উন্মেষ, তারই সূত্র ধরে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর- ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়।

যেহেতু অবিভক্ত পাকিস্তানের শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি অধিবাসের মুখের ভাষা ছিল “ বাংলা”। সুতরাং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রাধান্য পাবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথমে দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু শাসকচক্র বাঙালির প্রাণের দাবীর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে।

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলের অনুষ্ঠানেও তিনি এ ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেন। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকার এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী। 

গঠিত হয় “ তমদ্দুন মজলিস” ও “ ভাষা সংগ্রাম পরিষদ”। সর্বস্তরের বাঙালির অংশগ্রহণে মিছিল, মিটিং স্লোগানে মুখরিত হয় বাংলার আকাশ বাতাস এবং তা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ( ০৮ ফাগুন, ১৩৫৮ রোজ বৃহস্পতিবার) বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করা হয়। এই আন্দোলনের ভিড়ের মাঝে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সরকার গুলি বর্ষণ করে। যার ফলে অনেক ভাষা আন্দোলনকারী শহীদ হন। যার মধ্যে আমরা অন্যতম হিসেবে জানি রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকত সহ অনেকেই। তারপর থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে আমাদের কাছে। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি রক্ত বন্যার মধ্য দিয়ে আজ সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবময় আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে।  

বাংলাদেশেসহ বর্হিবিশ্বে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জাতীয় জীবনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। একুশ মানেই হলো- পরাশক্তির কাছে মাথা নত না করা। একুশ একটি বিদ্রোহ, বিপ্লব ও সংগ্রামের নাম। ‘একুশ’ হল মায়ের ভাষায় ভাষায় কথা বলার জন্য রাজপথ কাপানো মিছিল, স্লোগান, আন্দোলনে মুখরিত একটি মুহূর্ত।

আমরা বিভিন্ন কারনে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তন্মধ্যে প্রথম এবং অন্যতম কারণ হল ভাষার জন্য সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, বিপ্লব পৃথিবীর অন্য কোন এসে সংঘটিত হয়নি। ইতিহাসে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রত্যেক জাতিই জন্মগত ভাবে প্রাপ্ত ভাষায় স্বাধীনভাবে কথা বলে এবং মনের ভাব প্রকাশ করে। কিন্তু আমরাই প্রথম জাতি যারা ভাষার জন্য নিজের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। 

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, সাহিত্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ চেতনাবাহী একটি স্মরণীয় দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। এদিন বাঙালি সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। 

২১ তাই একটি সংখ্যামাত্র নয়, দিনপঞ্জিকার একটি দিনমাত্র নয়; অমর একুশে আমাদের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। একুশে মানে তাই মাথা নত না করা। আমাদের একুশ সেখানেই শেষ হয় নি। ৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন, ৬২ সালের ছাত্র অভ্যুত্থান, ৬৬ সালের ৬ দফা ভিত্তিক আন্দলোন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ৭০- এর সাধারণ নির্বাচনে বাঙালির অভাবনীয় সফলতা একুশকে কেন্দ্র করেই অর্জিত হয়েছে। মূলত একুশকে কেন্দ্র করেই বাঙালি সংগঠিত হয়েছে এবং আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে ন্যায্য অধিকার আদায়ের কৌশল রপ্ত করেছে। তাই একুশে মানে মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে জীবনের গান গেয়ে যাওয়া। একুশে মানে বাঙালির অহংকার। 

একুশ মানে এখন আর শোক নয়, একুশ এখন প্রতিজ্ঞা গ্রহণ, এগিয়ে চলার এবং প্রেরণার। বাঙ্গালী জাতি আজ বাধা অতিক্রম করে সামনে এগোনো শিখে গেছে। এ এগিয়ে যাবার ধারাবাহিকতায় আমাদের করণীয় হলো… পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গনে, সর্বত্র বাংলা ভাষার সঠিক প্রয়োগ এবং প্রীতিবোধ বজায় রাখা। 

অবশ্যই আমরা অন্যান্য ভাষার ব্যবহার শিখবো কিন্তু তা যেন কখনো আমাদের জন্য বিব্রতকর না হয়, আমাদের ভাষার জন্য হুমকি না হয়। 

আসুন আমরা সকলে মিলে, আমাদের এ অর্জনকে আরো অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে যাই। আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশে যে ভিশন ২০৪১, তারই সাথে সাথে বাংলাকেও আমরা আমাদের স্মার্টনেস হিসেবে বিশ্বে ছড়িয়ে দেই। 

সম্পর্কিত বিষয়:

জনপ্রিয়