দৃষ্টিনন্দন আমাজন রিভার ডলফিন
সমুদ্রের জীবন বরাবরই বেশ রঙিন। আর সমুদ্রের প্রাণীকূল বরাবরই সৌন্দর্যের আঁধার। প্রকৃতির সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় এই সামুদ্রিক প্রাণীগুলো। নাম না জানা কত সুন্দর প্রাণী এবং উদ্ভিদের বাসস্থান সেখানে। সেই সঙ্গে আবার চেনা প্রাণীরও মাঝে মধ্যে দেখা মিলে ভিন্ন রূপে। এর মধ্যে অন্যতম বন্ধুসুলভ দৃষ্টিনন্দন প্রাণী ডলফিন।
বিশ্বজুড়ে ৪০ প্রজাতির ডলফিনের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে কোনো কোনো তথ্যমতে ডলফিনের প্রজাতির সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। তবে আটটি প্রজাতি খুবই পরিচিত। ইরাবতী ডলফিন, পাখনাহীন পয়পয়েস ডলফিন, গাঙ্গেয় শুশুক, থেবড়া দাঁত ডলফিন, চিত্রা ডলফিন, ঘূর্ণি ডলফিন বোতল নাক ডলফিন ও গোলাপি ডলফিন। এর মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অঞ্চলে দেখা মিলে বিরল প্রজাতির প্রাণী গোলাপি ডলফিন। আমাজন রিভার ডলফিন নামেই এদের ডাকা হয়। নদীতে বসবাসকারী ডলফিনের চারটি প্রজাতির মধ্যে গোলাপি ডলফিন আকৃতিতে সবার বড়।
এর বৈজ্ঞানিক নাম ইনিয়া জিওফ্রেনসিস। এছাড়াও এরা বোটো, বুফেও নামেও পরিচিত। এদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকই হচ্ছে এদের গায়ের বর্ণ। প্রাপ্ত বয়সে এই ডলফিনের শরীরের বর্ণ পুরোপুরি গোলাপি হয়ে ওঠে। গোলাপি বর্ণের জন্য বিখ্যাত এই ডলফিনের রঙ শুরুতে কিন্তু গোলাপি ছিল না।
জন্মের সময় এদের রং ধূসর থাকে। এরপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রং পরিবর্তন হয়ে গোলাপি হয়। উত্তেজিত হলে এদের শরীর উজ্জ্বল গোলাপি রঙ ধারণ করে। সুন্দর শরীরের রং ছাড়াও এই ডলফিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এর ওজন ও আকৃতি। আকার আকৃতিতে এরা অন্যান্য অনেক জলজ প্রাণীকে হার মানাবে। জন্মের পর ডলফিনের ওজন হয় গড়ে ১ কেজি আর লম্বায় ৩০ ইঞ্চি। তবে প্রাপ্ত বয়সে ওজন গড়ে ৪৫০ পাউন্ডের বেশি এবং লম্বায় ৮ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এছাড়াও ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে এরা নিজেদের ঘাড় বাঁকাতে পারে। পাশাপাশি ধনুকের মতো বাঁকাতে পারে নিজের শরীর। এদের প্রধান খাদ্য মাছ। লম্বা ঠোঁট এবং চোয়ালের মধ্যে থাকা ২৮ জোড়া বড় দাঁতের সাহায্যে সহজেই শিকার ধরতে পারে। গোলাপি ডলফিনের মস্তিষ্কের সক্ষমতাও অনেক বেশি। মানুষের তুলনায় এদের মস্তিষ্কের সক্ষমতা প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।
গোলাপি রিভার ডলফিনের গড় আয়ু প্রায় ৩০ বছর। তবে এই প্রজাতির ডলফিনের ৪০ বছর পর্যন্ত জীবিত থাকার দৃষ্টান্ত আছে। আমাজন নদীর এই ডলফিনদের জন্য মানুষই একমাত্র হুমকি। অনেক শিকারি ক্যাটফিশের টোপ ধরে তাদের শিকার করে। দুঃখের বিষয় অনেকে এদের ধরতে কারেন্ট জাল ব্যবহার করেন।
ডলফিন দলবদ্ধ হয়ে থাকার জন্য বিখ্যাত হলেও গোলাপি ডলফিন একা থাকতে পছন্দ করে। দুই থেকে চার সদস্যের ছোট দলেই এরা অভ্যস্ত। তবে বেশি খাদ্য সমৃদ্ধ অঞ্চলে এদের বড় দল দেখা যায়। কৌতূহলী প্রাণী হওয়ায় গোলাপি ডলফিন সহজেই মানুষ কিংবা অন্য প্রজাতির সঙ্গে মিশে যায়।
২০০২ সালে প্রথমবারের মতো ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির একটি জরিপে বাংলাদেশে গোলাপি ডলফিনের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। নদী ও পরিবেশ দূষণ ও মানুষের আনাগোনা যেখানে বেশি সেখান থেকে এরা দূরে থাকে। তাই ফলে বঙ্গোপসাগরের নির্জন জায়গায় এদের মাঝে মধ্যে দেখা যায়।
২০১১ সালে এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটি প্রথম বঙ্গোপসাগরে দেখা মিলে। বাংলাদেশে সর্বশেষ গোলাপি ডলফিনের দেখা মিলেছে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী এবং সুগন্ধা পয়েন্টে স্থানীয়রা দুটি ডলফিন দলের সঙ্গে গোলাপি ডলফিনের দেখা পাওয়া যায়। গোলাপি ডলফিন নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী।
একটি কাহিনী প্রচলিত আছে, এই ডলফিন রাতে সুদর্শন পুরুষদের মোহিত করে। অন্য একটি কাহিনী অনুসারে, পানিতে একা সাঁতার কাটতে গেলে এরা সমুদ্রের তলদেশে জাদুর শহরে নিয়ে যায়। অনেক আমাজনীয় মনে প্রাণে বিশ্বাস করে গোলাপি ডলফিন একটি জাদুকরী মাছ যা মানুষের রূপ ধারণ করতে সক্ষম এবং উপকূলেও চলে আসতে পারে।
তথ্য সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য
ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী