নার্সদের কর্মবিরতি করায়, ভোগান্তিতে রোগীরা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি রাজধানীর শনির আখড়া থেকে আব্দুল হালিমের আট বছর বয়সী ছেলে রায়হান। ভর্তি হয়েছেন গতকাল সোমবার রাতে। পেট ফুলে যায়ও শরীলে পানি জমেছে। জরুরি বিভাগ থেকে পাঠানো হয়েছে ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলেছেন, অপুষ্টিজনিত ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুটি।
মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) সকালে শিশুটির রক্তের নমুনা সংগ্রহ ও প্রসাব পরীক্ষা করার কথা। কিন্তু সকাল থেকেই কোনো নার্স না থাকায় দুপুর ১২টা পর্যন্ত কোনো চিকিৎসায় পায়নি সেই শিশুটি।
শিশুর মা ফারজানা গণমাধ্যমকে বলেন, সকালে ডাক্তার এসেছিলেন। প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে গেছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলেছেন। নার্সরা সব ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু ওয়ার্ডে কোনো নার্স নেই। রাত থেকে শুধু স্যালাইনের উপরেই চলছে শিশুটি। বলতে গেলে কোনো চিকিৎসায় হয়নি। অথচ রাত থেকে ওর পেট আরো ফুলে গেছে। এখন কি করব বুঝতে পারছি না।
একই অবস্থা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। নার্সরা না থাকাই সেখানেও রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। হাসপাতালের তিনতলার শিশু ওয়ার্ডে সকালে ভর্তি হয়েছেন মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আসা শিশু আরাফাত। জরুরি বিভাগ থেকে তাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ভর্তির পর এগারোটা পর্যন্ত কোনো নার্সের দেখা পাননি শিশুর মা রোকসানা বেগম।
তিনি বলেন, পরিচিত লোক থাকায় বাচ্চাকে ভর্তি করতে পেরেছি। কিন্তু কোনো চিকিৎসা এখনো শুরু হয়নি। গত সোমবার রাতে প্রচন্ড খিচুনি দিয়ে কয়েকবার থেমে থেমে জ্বর আসে। এর মধ্যে অচেতন হয়ে পড়েছিল বাচ্চাটা। সকালে হাসপাতালে এনেছি। এখনো একই অবস্থা। ডাক্তাররা বলেছেন, সব লিখে দিয়ে গেছেন, নার্স আসলে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু কখন নার্স আসবে জানি না। বাচ্চাটার জ্বরও কমে না।
একই রকম দুর্ভোগ দেখা গেছে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল ও জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতালে। সেখানেও নার্স না থাকায় রোগীরা কোনো ধরনের চিকিৎসা পাননি সকালে। ডাক্তাররা এসে রুটিন রাউন্ড দিয়েছেন, নতুন প্রেসক্রিপশনও লিখে দিয়ে গেছেন। কিন্তু সেই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কোনো ওষুধ পাননি রোগীরা।
সারাদেশের সরকারি হাসপাতালে নার্সদের চার ঘণ্টার কর্মবিরতিতে সকাল ১১ টা পর্যন্ত রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে রোগীদের দুর্ভোগের এই চিত্র দেখা যায়।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল থেকে ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারের দাবিতে আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এই কর্মবিরতি চলে। এ সময় জরুরি বিভাগ, ডায়ালাইসিস, জরুরি অস্ত্রোপচার, আইসিইউ, পিআইসিইউ, এনআইসিইউ-সহ মুমূর্ষু ও জরুরি রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য নার্সদের বিশেষ স্কোয়াড থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো হাসপাতালেই এই চার ঘণ্টা কোনো নার্সকেই এই সেবা দিতে দেখা যায়নি।
এসব হাসপাতালে চিকিৎসকরা জানান, চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রোগীদের ওষুধ খাওয়ানো, স্যালাইন দেওয়া, শরীরের তাপমাত্রা মাপা, রক্ত সহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা, জরুরী পরিস্থিতিতে রোগীদের ব্যাপারে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজগুলো নার্সরাই করেন। কিন্তু কর্মবিরতির কারণে নার্সদের সেই সেবা রোগীরা পাচ্ছেন না এতে রোগীরা চিকিৎসকদের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। কোনো কোনো হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকদের বাক বিতণ্ডার কথাও শোনা গেছে।
হাসপাতালের দূই পরিচালক বলেন, এমনিতেই হাসপাতালে পদ অনুযায়ী নার্স নেই। কোনোভাবে অল্প নার্স দিয়ে রোগীদের সেবা দেওয়া হয়। তার উপর কর্মবিরতির কারণে নার্স না থাকাই চিকিৎসা সংকট তীব্র হয়েছে। এই পরিস্থিতির সমাধান না হলে হাসপাতাল চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়বে।
আজ মঙ্গলবার সকাল থেকেই কাজ ফেলে কর্ম বিরতিতে যান নার্সরা। সকালে জাতীয় বান ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউ হাসপাতালে দেখা গেছে, কাজ রেখে হাসপাতালে নিচে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে কর্মবিরতি পালন করছেন নার্সরা। এ সময় তাদের দাবির পক্ষে স্লোগান দিতে দেখা যায়।
হাসপাতালের নার্সরা বলেন, সাড়ে ৩০০ শয্যার এই হাসপাতালে নার্স ৬০০ মতো। কর্মবিরতির জন্য শুধু জরুরি বিভাগে নার্সরা কাজ করছেন। হাসপাতালে ওয়ার্ডগুলোতে দুপুর একটা পর্যন্ত কোনো নার্স কোনো ধরনের সেবা দেবেন না।
ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে দেখা যায়, কর্মবিরতি পালনের অংশ হিসেবে ব্যানার নিয়ে হাসপাতাল চত্বরে জড়ো হয়েছেন নার্সরা। দাবি আদায়ের জন্য তারা নানা ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসা রোগীদের সেবাদান ওই সময় বন্ধ ছিল। ওয়ার্ডে নতুন রোগী ভর্তির কাজও ছিল আটকে।
রোগী ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকাল থেকেই এই হাসপাতালের বহির্বিভাগের প্লাস্টার রুম বন্ধ। প্লাস্টার করার অপেক্ষায় অসংখ্য রোগীরা ভিড় করেছিল।
অবশ্য এই হাসপাতালে তিনতলার ওয়ার্ডে দুই তিনজন করে নার্স দেখা যায়। এসব নার্স জানিয়েছেন, ৮-১০ জন করে নার্স থাকেন প্রতিদিন। কর্মবিরতির জন্য জরুরি সেবা দিতে এখন আছেন ১-২ জন করে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের নিচে দেখা যায়, অস্ত্রোপচার কক্ষের পোশাক পরেই কর্মসূচিতে চলে এসেছেন নার্সরা। কর্ম বিরতি চলাকালে তারা কোনো অস্ত্রপচারে অংশ নেবে না, ওয়ার্ডেও যাবেন না।
কিন্তু ৬ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সাময়িকভাবে দুজন নার্সিং কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে পরিচালক পদে পূর্ণ দায়িত্ব না দিয়ে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্বে পদায়ন করে। এ কারণে ফের কর্মবিরতির ডাক দেওয়া হয়েছে বলে জানান নার্সিং ও মিডওয়াইফারি সংস্কার পরিষদের সদস্য সাব্বির মাহমুদ তিহান।